নিজস্ব প্রতিবেদক
মানিকগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সাবেক হিসাব সহকারী ইমরান নাজিরের বিরুদ্ধে বিচারকদের সই নকল করে ভুয়া পেমেন্টের মাধ্যমে প্রায় ৩৩ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই অবৈধ কাজে সহায়তাকারী হিসেবে জড়িত থাকার দায়ে ২১ ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে মামলা করেছেন দায়রা জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. সুজন শিকদার।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ৮ জুলাই ২০১৯ সাল থেকে ২২ আগষ্ট ২০২৪ সাল পর্যন্ত বরখাস্তকৃত ইমরান নাজির মানিকগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারকদের সই নকল করে প্রিয়েমশন সহ চলমান ও নিষ্পত্তিকৃত বিভিন্ন মামলার ভুয়া পেমেন্ট অর্ডার তৈরি করে শতাধিক মানুষের ৩২ কোটি ৬০ লাখ ৩২ হাজার ৭৬৭ টাকা আত্মসাত করা হয়েছে।
গত পাঁচ বছরে জালিয়াতির মাধ্যমে ২১ জনের ন্যাশনাল আইডি কার্ড দিয়ে খোলা ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে ২১ লাখ থেকে শুরু করে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত ভুয়া পেমেন্টের মাধ্যমে হিসাব রক্ষণ অফিস থেকে চেক ইসু করে ব্যাংক থেকে তুলে নিয়ে গেছে। অবৈধ এই কাজে সহায়তা করার অভিযোগ রয়েছে জেলা হিসাব রক্ষণ অফিসের ডিএএফও নজরুল ইসলাম,একই অফিসের সুপার দেওয়ান ফেরদৌস ওয়াহিদ, ইমরানের স্ত্রীর বড় ভাই রুবেল হোসেন, বোন জামাই আবুল হোসেন, চাচাতো ভাই হাবিবুর রহমান, ইমরান নাজিরের বন্ধু শরীফুল ইসলাম, ড্রাইভার জামাল ও ফুপা ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী মুনসুর আলম,স্থানীয় বারের ৫জন আইনজীবী একজন শিক্ষানবিসসহ ২১ জনের বিরুদ্ধে।
বিষয়টি জানার পরবর্তীতে স্বাক্ষর জালিয়াতির বিষয়ে ইমরান নাজিরকে পহেলা সেপ্টেম্বর কারণ দর্শানো দেন। ওই কারণ দর্শানো পাওয়ার পর ইমরান স্বাক্ষর জালিয়াতির বিষয়টি শিকার করেন। পরবর্তীতে হিসাব শাখার ভারপ্রাপ্ত বিচারক আসামী ইমরান নাজিরের কারণ দর্শানোর জবাবের ব্যখ্যা সন্তোষজনক নয় জানিয়ে গত নয়ই সেপ্টেম্বর জেলা জজ আসামী ইমরানের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য অফিসিশিয়াল স্মারকে পত্র প্রেরণ করে। এরপর জেলা ও দায়রা জজ আসামী ইমরান নাজিরের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করেন (মামলা নং ০৪/২০২৪)। আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর বিবেচনা হওয়ায় ১৮ই সেপ্টেম্বর ইমরানকে সাময়িক বরখাস্তের নির্দেশ দেন।
মামলার এজাহার সুত্রে জানা গেছে, আদালতের হিসাব শাখায় রক্ষিত বিভিন্ন রেজিস্ট্রারের পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আসামী ইমরান নাজির সরকারী অর্থ আত্মসাতের নিমিত্ত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হিসাব বিভাগে রক্ষিত পরাতন রেজিস্ট্রারকে টার্গেট করেন। সেখান থেকে যে সকল মামলার অর্থ ইতোমধ্যে উত্তোলন হয়েছে এবং কোন পক্ষ বা আইনজীবী আসার কারণ নেই সেই সকল মামলার বিপরীতে প্রদর্শিত অর্থের পরিমান ঘষাসাজা এবং নয়ছয় করে নতুন অ্যামাউন্ট বসিয়ে অর্থ জালিয়াতি করে উত্তোলন করেন।
নতুন চলমান মামলা থেকেও জালিয়াতি করে বিপুল পরিমান অর্থ অন্যান্য আসামীদের সাথে যোগসাজসে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আদালতের বিচারক,সেরেস্তাদার বেঞ্চ সহকারী,ভারপ্রাপ্ত বিচারক (নেজারত বিভাগ) বা ভারপ্রাপ্ত বিচারক (হিসাব বিভাগ) এর বিচারকদের স্বাক্ষর জাল করে চালান,পেমেন্ট অর্ডার ও অন্যান্য কাগজপত্র প্রস্তুত করেন। এরপর ইমরান নাজির অবৈধভাবে সরকারী অর্থ আত্মসাতের জন্য জেলা বারের অসাধু ৫জন আইনজীবী,নিকট আত্মীয়স্বজন,নিজের গাড়ির ড্রাইভারকে পক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করেন।
মামলার এজাহার পর্যালোচনা করে জানা গেছে, এজাহারের ৪ নম্বর আসামী আবুল হোসেনের জাতীয় ভোটার আইডি কার্ড দিয়ে খোলা ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ২০২২ সালের আগষ্ট মাস থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ২ কোটি ১৯ লাখ ৪০ হাজার ৮০ টাকা, ৫ নম্বর আসামী ইমরানের গাড়ির ড্রাইভার মো. জামালের ভোটার আইডি কার্ড দিয়ে খোলা ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ২০২২ সালের আগষ্ট মাস থেকে ২০২৩ সালের আগষ্ট মাস পর্যন্ত ১ কোটি ৫৯ লাখ ৬৭ হাজার ৮৪১ হাজার টাকা, ৬নম্বর আসামী মো, হাফিজুর রহমান ২০২৩ সালের জানুয়ারী থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত তার জাতীয় ভোটার আইডি কার্ড দিয়ে খোলা ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ৬৮ লাখ ১৪ হাজার ৩০০ টাকা, ৭ নম্বর আসামী মো. রুস্তুম আলী ২০২২ সালের অক্টোবর মাস থেকে ২০২৩ সালের আগষ্ট মাস পর্যন্ত তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ১ কোটি ৬১ লাখ ২৭ হাজার ৮৯ টাকা, ৮ নম্বর আসামী মো. রুবেল হোসেন ২০২২ সালের জুলাই মাস থেকে ২০২৩ সালের আগষ্ট মাস পর্যন্ত তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ১ কোটি ২৫ লাখ ১৮ হাজার ৫১ টাকা, ৯ নম্বর আসামী মো. ফরিদ রায়হান ২০২৩ সালের মে মাস থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ৩১ লাখ ৪৭ হাজার টাকা,১০ নম্বর আসামী অ্যাডভোকেট আফরিন আক্তার মিম ২০২৩ সালের মে মাস থেকে ২০২৪ সালের ফেব্রয়ারী মাস পর্যন্ত তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ৫১ লাখ ৯ হাজার ৪৪৩ টাকা,১১ নম্বর আসামী মো. শরীফুল ইসলাম ২০২২ সালের জুন মাস ২০২৩ সালের সেপ্টম্বর মাস পর্যন্ত তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ৩ কোটি ৭৫ লাখ ১১ হাজার ৬৮৩ টাকা,১২ নম্বর আসামী মো. মুনসুর আলম ২০২৩ সালের জুলাই মাস থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ৩০ লাখ ৫১ হাজার ৭৯০ টাকা, ১৩ নম্বর আসামী কানন আক্তার ২০২৩ সালের মার্চ থেকে ২০২৩ সালের আগষ্ট মাস পর্যন্ত তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ৯৮ লাখ ২১ হাজার ৮০০ টাকা, ১৪ নম্বর আসামী হুমায়ন কবীর ২০২২ সালের মার্চ থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ৩ কোটি ৪৭ লাখ ৮৬ হাজার ৪৮৩ টাকা, ১৫ নম্বর আসামী মাহফুজুর রহমান মিটুল ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ১ কোটি ৭৬ লাখ ৮৬ হাজার ৯৭০ টাকা, ১৬ নম্বর আসামী নিলুফা আক্তার ২০২২ সালের ২০২৩ সালের আগষ্ট মাস পর্যন্ত তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ১ কোটি ৪১ লাখ ৮০ হাজার ৬০৪ টাকা,১৭ নম্বর আসামী রেহেনা খানম ২০২২ সালের এপ্রিল মাস থেকে ২০২৩ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ১ কোটি ৪১ লাখ ৮০ হাজার ৬০৪ টাকা, ১৮ নম্বর আসামী অ্যাডভোকেট জেসমিন রহমান বিথী তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ৪৮ লাখ ৯১ হাজার ১১০ টাকা, ১৯ নম্বর আসামী আতিকুর রহমান ২০২৩ সালের মার্চ থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়াদে ১ কোটি ৬১ লাখ ৭৯ হাজার ৮৫৭ টাকা ও ২১ নম্বর আসামী মো. ফজলুল হক ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ২১ লাখ টাকা উত্তোলন অবৈধ ভাবে উত্তোলন করে আত্মসাত করেছে।
মামলার ৩ নম্বর আসামী হিসেবে ডিস্ট্রিক এ্যাকাউন্টস এন্ড ফিন্যান্স অফিসার (ডিএএফও) মো. নজরুল ইসলাম বলেন, একই বিল দুইবার প্রেমেন্ট হয়ে যাবে এ কারনে তাকে (আব্দুস সামাদ মোল্লা) ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের কাছে জজ কোট থেকে বিল আসে আমরা যাচাই করে,আমাদের যে পক্রিয়া আছে, অডিটরের কাছে প্রথমে জমা হবে,তাঁরা বিল দেখে শুনে সুপারের কাছে জমা দিবে,তারপর আমার টেবিলে আসলে চেক ইসু হবে। আমি জজ কোর্ট থেকে বিল পেয়েছি, তাদের বিল সঠিক বলে ইসু করেছি। তিনি বলেন, এ ঘটনায় আমার নামে এবং আমার অফিসের সুপার দেওয়ান ফেরদৌস ওয়াহিদের নামে যে মামলা হয়েছে তা আমরা জানি না। আপনাদের মাধ্যমে প্রথম জানতে পারলাম। তার দাবি তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এটা এভাবে বলা যাবে না, আদালতের টাকা তসরুফ হয়েছে।
এদিকে অভিযোগের বিষয়ে দুবাইতে পলাতক থাকা অভিযুক্ত কুষ্টিয়ার বাসিন্দা ইমরান নাজিরের সঙ্গে বার বার যোগাযোগের করা হয়েছে। তিনি বক্তব্য দিবেন বলে তিনদিন ঘুরিয়ে আর বক্তব্য দেননি। পরে তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা হলে তিনি ঘটনার সত্যতা শিকার করে বলেন, আমার স্বামী ইমরান নাজির দুবাইতে আছে। মামলা হলে কি হবে,মূল ব্যক্তি তো নাই। আমার জানামতে ইমরানের কাকাতো ভাই হাবিবুর রহমান (২০ নম্বর আসামী) এবং ইমরানের বন্ধ শরীফুল ইসলাম (১১ নম্বর আসামী) মুল ব্যক্তি। এদের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে যতটাকা তোলা হয়েছে সব তারা নিয়ে ভেগে গেছে।
এ ঘটনায় জেলা আইনজীবী সমিতির সিনিয়র সদস্যরা এক ধরনের হতাশা প্রকাশ করেছেন, বিষয়টি নিয়ে কথা হয় দুর্ণীতি দমন কমিশনের মানিকগঞ্জের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মো, আজিজ উল্লাহ’র সঙ্গে তিনি বলেন, আমার প্রায় ৫০ বছর ওকালতির বয়স। এই ৫০ বছরের মধ্যে কখনো শুনিনি কোর্টের টাকা অন্যত্র চলে গেছে। এটা আমার জন্য না,মানিকগঞ্জবাসীর জন্য না, এটা সারা বিচার বিভাগকে নাড়িয়ে তুলবে। এতদিনের মধ্যে পাবলিক জানে না, আমরা জানি না, যারা ঘটনা ঘটিয়েছে তারা তো ওইদিন থেকে জানেন। এটা পরিকল্পনা একদিনে হয় নাই। আইন তো নিজের গতিতে চলবে,তবে চলাটা যেন তরিৎ গতিতে হয়। এটা যেন হিমাগারে চলে না যায়।
এ বিষয়ে কথা হয় মামলার বাদি জেলা দায়রা জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. সুজন শিকদারের সঙ্গে তিনি বলেন, পুর্বের কিছু মামলা যেগুলো নিষ্পত্তি হয়েছে সেগুলো থেকে, চলমান কিছু মামলা থেকে টাকা আত্মসাত করেছে। দেখা গেছে রানিং মামলায় জমা আছে পাঁচলাখ টাকা ইমরান ওইটায় বসিয়ে দিয়েছে ৫০ লাখ টাকা। ডিস্ট্রিক এ্যাকাউন্টস এন্ড ফিন্যান্স অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে পক্ষকে কিছু টাকা দিয়েছে এবং অতিরিক্ত টাকা আত্মসাৎ করেছে।
তিনি বলেন, জেলা বারের কিছু আইনজীবীর সিল জাল করা আছে, তা দেখে মনে হচ্ছে কিছু আইনজীবী জরিত রয়েছে। এগুলোর প্রাথমিক তদন্ত হয়েছে তদন্তে প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। ওই হিসেবে আমাদের এখান থেকে আমি (সুজন শিকদার) বাদি হয়ে দুর্ণীতি দমন কমিশনে ২১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।